চীনাবাদামের আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি
চীনাবাদামের উন্নত জাত :
‘ বিনাচীনাবাদাম -৪ ’ :- জাতটি খরাসহিষ্ণু ফলে চর এলাকায় চাষাবাদের জন্য উপযােগী । কলার রট , সার্কোস্পােরা লিফ স্পট ও মরিচা রােগ সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন । বাদাম ও বীজ মাতৃজাত ঢাকা -১ এর চেয়ে বড় , ফলে বাজারে চাহিদা বেশি থাকার ফলে কৃষক সহজেই বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে । ফলন - খরিফ মৌসুমে ২.৪৭ টন / হেক্টর ।
বাসন্তী বাদাম ( ডিজি -২ ) :-
গাছের উচ্চতা ৩০-৩৫ সেমি এবং আকৃতি অল্প ছড়ানো । প্রতি গাছে ৮-১০টি শাখা থাকে । পাতার রং গাঢ় সবুজ । প্রতিটি বাদামে বীজের সংখ্যা ১-২টি । বীজের আকার বড় , লম্বা এবং রং লালচে বাদামী । বাদামের জীবনকাল ১৫০-১৬০ দিন । এ জাত গােড়া ও কান্ড পচা রােগ এবং পাতার দাগ রোগ সহনশীল ও প্রতিরােধী ।
ঝিঙ্গা বাদাম ( এসিসি -১২ ) :- গাছের উচ্চতা ৩৫-৫০ সেমি । গাছ খাড়া । প্রতি গাছে ৫-৮টি শাখা থাকে । পাতার রং হালকা সবুজ । প্রতিটি বাদামে বীজের সংখ্যা ২-৪টি । বীজের আকার মধ্যম , চেপ্টা এবং রং হালকা বাদামী । ১০০ বীজের ওজন ৪০-৪৫ গ্রাম । ফসলের জীবনকাল খরিপ মৌসুমে ১৩০-১৪০ দিন ।
ত্ৰিদানা বাদাম ( ডিএম -১ ) :-
গাছের উচ্চতা ১০-১২ সেমি । প্রতি গাছে ৯-৭টি শাখা থাকে । পাতার রং গাঢ় সবুজ । প্রতিটি বাদামে । বীজের সংখ্যা ১-৪টি । বীজের আকার মধ্যম , লম্বা এবং গাঢ় লাল । ১০০ বীজের ওজন ২৬-২৮ গ্রাম । ফসলের জীবনকাল ১০৫ - ১১৫ দিন । হেক্টর প্রতি ২.২-২.৪ টন পাওয়া যায় ।
বারি চীনাবাদাম -৫ :-
গাছের উচ্চতা ৩৫-৪০ সেমি । গাছ খাড়া ও গুছকার । পাতার রং হালকা সবুজ । শাখা প্রশাখায় ফুল হয় । প্রতি বাদামে বীজের সংখ্যা ১-২টি । বাদামের শিরা উপশিরা খুব স্পষ্ট , বীজের আকার বড় । ১০০ বীজের ওজন ৪৮-৫০ গ্রাম । | বীজের সুপ্তিকাল ১০-১৫ দিন । বীজের তেলের পরিমাণ ৫১-৫২ % । জীবনকাল : খরিফ মৌসুমে ১১৫-১২৫ দিন । হেক্টর প্রতি ফলন খরিফ মৌসুমে ২.০-২.৫ টন ।
বারি চীনাবাদাম -৬ :-
গাছ খাড়া ও গুচ্ছকৃতির হয় । পাতার রং গাঢ় সবুজ । চীনাবাদামের খােসার উপরিভাগ মসৃণ , পাতলা , শিরা , উপশিরা অসস্পষ্ট । বীজের রং হালকা বাদামী । ১০০ বীজের ওজন ৫০-৫৫ গ্রাম । আমিষের পরিমাণ ২৫-২৬ % । খরিফ মৌসুমে ১২০-১৩০ দিন । হেক্টর প্রতি ফলন রবি মৌসুমে ২.৫-২.৮ টন এবং খরিফ মৌসুমে ২-২.৪ টন ।
বারি চীনাবাদাম -৭ :-
জীবনকাল খরিফ মৌসুমে ১৩০-১৪০ দিন । বাদামের খােসা মসৃণ ও কিছুটা সাদাটে ও নরম । পাতার দাগ পড়া ও মরিচা রােগ তুলনামূলকভাবে কম হয় ।
বারি চীনাবাদাম -৮ :-
গাছের উচ্চতা ৩৫-৪২ সেমি । প্রতি গাছে বাদামের সংখ্যা ২০-২৫টি । বীজের আকার মাঝারী , বীজের রং লালচে । ১০০ বাদামের ( খোসা ছড়ানো ) ওজন ৫৫-৬০ গ্রাম । ফলন প্রতি হেক্টরে ২.৫ টন ।
বারি চীনাবাদাম -৯ :-
গাছের উচ্চতা মাঝারী ধরনের ( ৪০-৪৫ সেমি ) । প্রতিটি গাছ থেকে ২০-২২টি পুষ্ট বাদাম পাওয়া যায় । বাংলাদেশের চরাঞ্চলের জমিতে চাষাবাদ জন্য খুবই উপযুক্ত ।
বারি চীনাবাদাম -১০ :-
গাছের উচ্চতা মাঝারী ধরনের ( ৪০-৪৫ সেমি ) । প্রতিটি গাছ থেকে ২০-২২টি পুষ্ট বাদাম পাওয়া যায় । বাদামের খােসা কিছুটা অমসৃণ ও শিরা উপশিরাগুলাে স্পষ্ট । বীজের আকার মাঝারী এবং রং হালকা বাদামী । ১০০ বীজের ওজন । ৪৫-৪৭ গ্রাম । প্রতি হেক্টরে ফলন ২.৫-২.৮ টন ।
বপনের সময় :- বছরের যে কোনাে সময় এর চাষ করা যায় । খরিফ মৌসুমে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ( আষাঢ় - আশ্বিন ) পর্যন্ত বীজবপন করলে ভালাে ফলন পাওয়া যায় ।
চাষ উপযােগী জমি :- বেলে , বেলে দো - আঁশ ও এঁটেল দো - আঁশ মাটিতে এ জাতের অধিক ফলন পাওয়া যায় ।
জমি তৈরি , বপন পদ্ধতি ও বীজের পরিমাণ :-
তিন - চারটি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে বীজবপন করতে হয় । শেষ চাষের সময় নির্ধারিত পরিমাণ সার দিয়ে চাষ ও মই দিতে হবে । বীজ সারিতে বপন করতে হবে ।
সারি থেকে সারির দূরত্ব ১২ ইঞ্চি ( ৩০ সেমি . ) এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৬ ইঞ্চি ( ১৫ সেমি . ) রাখতে হবে । বীজগুলাে ১.০-১.৫ ইঞ্চি মাটির নিচে পুঁতে দিতে হবে । হেক্টরপ্রতি ১২৫-১৩০ কেজি ( একরপ্রতি ১৭ কেজি ) বীজের প্রয়ােজন হয় ।
সার মাত্রা ও প্রয়ােগ পদ্ধতি :
তবে বেলেমাটির ক্ষেত্রে বােরন ও মলিবডেনাম ১-১.৫ কেজি প্রতি হেক্টরে প্রয়ােগ করা প্রয়ােজন । জমি উর্বর হলে ইউরিয়া অর্ধেক প্রয়ােগ করতে হবে এবং দস্তা সার প্রয়ােগের প্রয়ােজন নেই । সব প্রকার সার শেষ চাষের পূর্বে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়ােগ করতে হবে । অন্যদিকে জীবাণুসার ব্যবহার করলে ইউরিয়া প্রয়ােগের প্রয়ােজন নেই ( জীবাণুসার একরপ্রতি ৩০০ গ্রাম ) ।
জীবাণুসার ব্যবহারের নিয়মাবলী :-
> সুস্থ , সতেজ ও শুকনা বীজে পরিমাণ মতো চিটাগুড় মিশিয়ে নিন যাতে বীজগুলাে আঠালাে মনে হয় ( চিটগুড়ের অভাবে ঠান্ডাভাতের মাড় বা পানি ব্যবহার করুন ) ।
> আঠালাে বীজগুলাের সংগে জীবাণুসার ভালোভাবে মিশিয়ে নিন যাতে প্রতিটি বীজে কালাে প্রলেপ পড়ে যায় ।
> কালো প্রলেপযুক্ত বীজ ছায়ায় সামান্য শুকিয়ে নিন যাতে বীজগুলাে গায়ে গায়ে লেগে না থাকে ।
> জীবাণুসার মিশ্রিত বীজ রৌদ্রহীন বা খুবই অল্প রৌদ্রে বপন করে বীজগুলাে মাটি দিয়ে তাড়াতাড়ি ঢেকে দিতে হবে ।
> ঠান্ডা , শুষ্ক , রােদমুক্ত জায়গায় জীবাণুসার এবং জীবাণুসার মিশ্রিত বীজ রাখতে হবে । জীবাণুসার উৎপাদনের ১৮০ দিনের মধ্যেই ব্যবহার করা উত্তম ।
আগাছা দমন : চারা গঁজানাের ২৫-৩০ দিন পর নিড়ানি দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে হালকাভাবে আগাছা উঠিয়া ফেলতে হবে । শিকড়ে যেন কোনাে প্রকার আঘাত না লাগে সেদিকে লক্ষ রাখা দরকার ।
পানি সেচ : চীনাবাদাম চাষে স্বাভাবিক অবস্থায় সেচ দেয়ার প্রয়ােজন হয় না । তবে পানির অত্যধিক অভাব হলে একবার হালকা সেচ দেয়া যেতে পারে ।
চীনাবাদামের ক্ষতিকর পােকামাকড় ও রােগ বালাইয়ের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা :
চীনাবাদামের উইপােকার ক্ষতির ধরণ :-
> এ পােকা গাছের শিকড় খেয়ে ফেলে বা কেটে নষ্ট করে ।
> শিকড়ের ভিতর গর্ত সৃষ্টি করে । ফলে গাছ মারা যায় ।
> এ পােকা বাদামের খােসা ছিদ্র করে বীজ খায় ।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনা :-
> পানির সাথে কেরােসিন মিশিয়ে সেচ দিলে উইপােকা জমি ত্যাগ করে ।
> মাটির পাত্রে পাটের কাঠি ভর্তি করে পুঁতে রাখলে তাতে উইপােকা লাগে । এরপর পাত্রের উইপোকা মেরে ফেলতে হবে ।
> আক্রান্ত মাঠে কার্বোফুরান ৫ জি বা ডায়াজিনন ১০ জি বা বাসুডিন ১০ জি বা লর্সবান ১৫ জি যথাক্রমে হেক্টর প্রতি ১০ , ১৫ ও ১৪ কেজি হারে জমিতে প্রয়ােগ করতে হবে ।
চীনাবাদামের শুয়া / বিছাপােকার ক্ষতির ধরণ :-
> এ পােকা গাছের পাতা খেয়ে ঝাঝরা করে ফসলের সমূহ ক্ষতি করে ।
সমম্বিত ব্যবস্থাপনা:-
> হাত দিয়ে আক্রান্ত পাতা হতে কীড়া বা পােকার ডিম সংগ্রহ করে মেরে ফেলা ।
> প্রয়ােজনে প্রতি লিটার পানিতে ক্যারেটে ১ মিলি বা সেভিন ৩ গ্রাম বা ২ মিলি ডায়াজিনন বা ১ মিলি রিপকর্ড মিশিয়ে স্প্রে করা ।
চীনাবাদামের রোগ বালাইয়ের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা
চীনাবাদামের পাতার দাগ ( টিক্কা ) রােগের লক্ষণঃ
> এ রােগের কারণে পাতার উপরে হলদে রেখা বেষ্টিত বাদামী রংয়ের গােলাকার দাগ সৃষ্টি হয় । > দাগগুলাে ক্রমেই বড় হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে ।
> দাগগুলাে গাঢ় বাদামি হতে কালচে বর্ণের হয় এবং ধীরে ধীরে পাতা ঝরে যায় ।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনা :-
> আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলা ।
> ফসল কাটার পর আগাছা পুড়িয়ে ফেলা ।
> রােগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম ব্যাভিষ্টিন / নােইন বা ২ গ্রাম ভাইথেন এম -৪৫ মিশিয়ে ১২-১৫ দিন পর ২-৩ বার স্প্রে করা ।
চীনাবাদামের পাতার মরিচা রােগের লক্ষণ :
> বয়স্ক গাছেই এ রােগের আক্রমণ বেশি হয় ।
> পাতার নিচের দিকে প্রথমে মরিচা পড়ার ন্যায় সামান্য উঁচু বিন্দুর মত দাগ দেখা যায় এবং দাগ ধীরে ধীরে বড় হয় ।
> আক্রমণ বেশি হলে পাতার উপরের পিঠে এ রোগ দেখা যায় ।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনা :
> ফসল কাটার পর পরিত্যক্ত গাছ , আগাছ বা নাড়া পুড়িয়ে ফেলা ।
> আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে নষ্ট করা ।
> এ রোগ দেখা দিলে ক্যালিক্সিন ১ মিলি বা টিল্ট ২৫০ ইসি ০,৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ।
ফসল সংগ্রহ : জাত ও মৌসুমভেদে চীনাবাদাম ১২০-১৫০ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করা হয় ।
পরামর্শ / সতর্কতা :
> এলাকায় উপযােগী জাত বাছাই করা ।
> বপনের আগেই বীজের গঁজানাের হার পরীক্ষা করা ।
> একই জমিতে বার বার চীনাবাদাম চাষ না করা ।
0 Comments